বন্য প্রাণী লোকালয়ে ঢোকে কেন?

সম্প্রতি মানিকগঞ্জে ধরা পড়া রাসেল ভাইপার সাপ আবারও জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনাগুলো আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে, এই প্রাণী হঠাৎ আমাদের ঘরে, উঠানে কিংবা লোকালয়ে কেন চলে আসে? বর্তমানে একটি জটিল ও চিন্তাজনক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, মানুষের সঙ্গে বন্যপ্রাণীর বিরোধ।

এই বিরোধ শুধু পাহাড়ি অঞ্চল বা বনাঞ্চলে নয়, এখন তা শহরাঞ্চলেও চোখে পড়ছে। বিশেষ করে বর্ষাকাল এলে পরিস্থিতি আরও প্রকট হয়ে ওঠে। মানুষের ঘরে, উঠানে কিংবা আশপাশের লোকালয়ে আমরা প্রায়ই নানা ধরনের বন্য প্রাণীর উপস্থিতি লক্ষ্য করি। কখনো ছোট পোকামাকড়, পিঁপড়া, টিকটিকি, তেলাপোকা কিংবা মাকড়সা, আবার কখনো বড় প্রাণী যেমন সাপ, শিয়াল বা বেজি পর্যন্ত আশ্রয় নিতে আসে মানুষের বসতিতে।

প্রকৃতপক্ষে প্রাণীরা কোনো হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে মানুষের ঘরে আসে না। এর পেছনে রয়েছে পরিবেশগত সংকট ও বাসস্থান সংকট। বর্ষাকালে যখন নিচু অঞ্চল প্লাবিত হয়, বনভূমি বা খাল-বিল পানিতে ডুবে যায়, তখন প্রাণীরা বাধ্য হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে উঁচু স্থানে চলে আসে। এই উঁচু স্থান অনেক সময়েই হয় মানুষের বসতবাড়ি। এমনকি শহরের ড্রেন বা নির্মাণাধীন ভবনেও তারা আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।

এছাড়াও মানুষের অসচেতনতা ও পরিবেশ ধ্বংসের কারণে প্রাণীরা তাদের প্রাকৃতিক বাসস্থান হারিয়ে ফেলছে। প্রতিটি প্রাণীর একটি স্বতন্ত্র বাসস্থান থাকে; বন, ঝোপঝাড়, গর্ত, জলাশয়, পাহাড় বা বালুর চর। কিন্তু মানুষ তার বাসস্থান ও কৃষিকাজ, শিল্পায়ন, অবকাঠামো নির্মাণ, রাস্তাঘাট তৈরি ইত্যাদি উদ্দেশ্যে প্রতিনিয়ত এই প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে চলেছে। ফলে প্রাণীরা কোথাও আশ্রয় না পেয়ে বাধ্য হয়ে লোকালয়ের দিকে ছুটে যাচ্ছে।

শুধু সাপ বা শিয়াল নয়, বর্ষায় পিঁপড়া, তেলাপোকা, আরশোলা, ব্যাঙ, এমনকি গুঁইসাপের মতো প্রাণীও মানুষের ঘরে দেখা যায়। এসব প্রাণীরও নিরাপদ আশ্রয়ের প্রয়োজন। কিন্তু তাদের সে পরিবেশ আমরা দখল করে নিচ্ছি বা ধ্বংস করে ফেলছি।

প্রকৃতপক্ষে প্রাণীরা কোনো হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে মানুষের ঘরে আসে না। এর পেছনে রয়েছে পরিবেশগত সংকট ও বাসস্থান সংকট। বর্ষাকালে যখন নিচু অঞ্চল প্লাবিত হয়, বনভূমি বা খাল-বিল পানিতে ডুবে যায়, তখন প্রাণীরা বাধ্য হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে উঁচু স্থানে চলে আসে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরিবেশগত সচেতনতা এখনো খুবই সীমিত। অধিকাংশ মানুষ জানেই না যে, একটি সাধারণ সাপ বা ব্যাঙও পরিবেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। নির্বিষ দাঁড়াশ সাপ ইঁদুর খেয়ে ফসল রক্ষা করে, ব্যাঙ মশার লার্ভা খেয়ে ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে সাহায্য করে। এই প্রাণীগুলো পরিবেশের খাদ্যচক্রের অংশ। কিন্তু মানুষের জ্ঞান ও সচেতনতার অভাবে আমরা প্রাণীদের শত্রু হিসেবে দেখি, তাদের মেরে ফেলার মধ্যে বীরত্ব খুঁজি।

অনেক এলাকায় দেখা যায়, কোনো প্রাণী ঘরে ঢুকলেই তাকে হত্যা করা হয়, ভয় বা অজ্ঞতার কারণে। অথচ প্রাণীটি হয়তো একদিনের জন্যই পানি থেকে বাঁচতে এসেছে। এভাবে প্রাণী হত্যা কেবল নিষ্ঠুরতাই নয়, এটি পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে। আমাদের উচিত হবে প্রাণীর সঙ্গে সহাবস্থানের শিক্ষা গ্রহণ করা।

প্রতিটি প্রাণীর বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। মানুষ যেমন নিরাপত্তা ও খাদ্য চায়, তেমনি প্রাণীরাও চায় নিরাপদ বাসস্থান ও খাদ্যের নিশ্চয়তা। এই বাস্তবতা যদি আমরা না বুঝি, তাহলে প্রাণীদের সঙ্গে বিরোধ বাড়তেই থাকবে, যার পরিণাম একসময় আমাদেরই ক্ষতির কারণ হবে।

মানুষ ও প্রাণীর বিরোধ রোধ করতে হলে আমাদের পরিবেশ নিয়ে ভাবতে হবে। সবার আগে দরকার পরিবেশ রক্ষার জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ। বনভূমি ধ্বংস বন্ধ করতে হবে, তৃণভূমি সংরক্ষণ করতে হবে এবং জলাশয় ভরাট করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সরকারি পর্যায়ে যেমন নীতিমালা দরকার, তেমনি ব্যক্তি ও পারিবারিক পর্যায়েও সচেতনতা জরুরি।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী নিয়ে আলাদা শিক্ষা চালু করা যেতে পারে। শিশুদের ছোটবেলা থেকেই শেখাতে হবে প্রাণী আমাদের শত্রু নয়, তারা আমাদের বন্ধু। সোশ্যাল মিডিয়া, টেলিভিশন ও গণমাধ্যমে পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন নিয়ে প্রচার জোরদার করতে হবে।

স্থানীয় সরকার, সিটি কর্পোরেশন এবং গ্রামীণ এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির কর্মসূচি নেওয়া যেতে পারে। যেসব এলাকায় সাপের প্রবণতা বেশি, সেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী ও সরঞ্জাম থাকা উচিত, যেন মানুষ প্রাণীটিকে মেরে না ফেলে বরং নিরাপদে সরিয়ে দেয়।

পরিবেশ সচেতনতা বাড়ানোর জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ করণীয়

পরিবেশ সচেতনতা বাড়াতে আমাদের অবশ্যই কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত, অপ্রয়োজনে বনাঞ্চল ধ্বংস বন্ধ করতে হবে, যাতে প্রাণীদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল রক্ষা পায়। বসতবাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখা এবং কোথাও পানি জমতে না দেওয়ার মাধ্যমে মশা ও পোকামাকড়ের বিস্তার রোধ করা সম্ভব। প্রাণী দেখে আতঙ্কিত না হয়ে স্থানীয় পরিবেশ অফিসে যোগাযোগ করা উচিত, যেন তাদের সঠিকভাবে উদ্ধার বা ব্যবস্থাপনা করা যায়।

শিশুদের বন্যপ্রাণীর উপকারিতা সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া এবং পরিবেশবান্ধব মনোভাব গড়ে তোলা আবশ্যক। পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ এবং মিডিয়া ও সামাজিক প্ল্যাটফর্মে সচেতনতামূলক বার্তা প্রচার করে জনগণকে পরিবেশ রক্ষায় উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। এসব উদ্যোগ একত্রে গ্রহণ করলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইতিমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। একদিকে যেমন অতিবৃষ্টি ও দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে খরা ও পানির সংকটও বাড়ছে। এই বৈপরীত্যের শিকার হচ্ছে শুধু মানুষ নয়, প্রাণীরাও। যখন বৃষ্টির পানি একটানা পড়ে এবং নিচু জমি প্লাবিত হয়, তখন প্রাণীরা বাধ্য হয় তাদের আবাসস্থল ছেড়ে অন্যত্র গমন করতে। এতে অনেক প্রাণী শহরাঞ্চল বা লোকালয়ে চলে আসে, যা মানুষের জন্য নতুন হুমকি তৈরি করে।

বন্যপ্রাণীর এই ঘন ঘন মানুষের সংস্পর্শে আসার ফলে রোগজীবাণু ছড়ানোর সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। জুনোটিক রোগ (Zoonosis Disease) যেমন নিপাহ ভাইরাস (Nipah virus), লেপ্টোস্পাইরোসিস (Leptospirosis), এমনকি নতুন ধরনের ভাইরাল সংক্রমণও প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে। অতীতে আমরা যেভাবে COVID-19 বা ইবোলা ভাইরাসের উৎস হিসেবে বন্যপ্রাণীর দিকে তাকিয়েছি, তা প্রমাণ করে যে এই বিরোধ কেবল পারিপার্শ্বিক নয়, এর গভীরে রয়েছে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি।

মানুষের জীবনধারায় পরিবর্তন আনা এখন সময়ের দাবি। আমাদের বাড়ি নির্মাণ, কৃষিকাজ, শিল্প স্থাপন, সব কিছুর পেছনে পরিবেশ-সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি থাকা উচিত। যেখানে বন আছে সেখানে বন রেখে পরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো গড়ে তোলা যেতে পারে। বন্যপ্রাণীদের করিডোর বা চলাচলের পথ অবরুদ্ধ না করে সেগুলো সংরক্ষণ করা যেতে পারে। অনেক দেশে বন্যপ্রাণীর চলাচলের জন্য আন্ডারপাস, ওভারপাস বা নির্দিষ্ট করিডোর নির্মাণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও এমন উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা দরকার।

প্রযুক্তির ব্যবহার করে বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষণ করা এবং ডেটা সংগ্রহ করে তাদের গতিবিধি ও মৌসুমি অভ্যাস বোঝা সম্ভব। এই তথ্য ব্যবহার করে আমরা পূর্বাভাস দিতে পারি কখন কোথায় প্রাণীর লোকালয়ে প্রবেশের সম্ভাবনা বেশি এবং সেই অনুযায়ী পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করা যায়।

শহর এলাকায় প্রায়ই দেখা যায়, গৃহস্থালির বর্জ্য যেখানে-সেখানে ফেলে রাখা হয়। এতে বেজি, শিয়াল, এমনকি বানরের মতো প্রাণীও খাবারের সন্ধানে চলে আসে। এই সমস্যা প্রতিরোধে কঠোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। বন্যপ্রাণীকে খাবার খাওয়ানো বা তাদের আশ্রয় দেওয়া ক্ষতিকর হতে পারে। এর ফলে তারা মানুষকে নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে চিনে ফেলে এবং নিয়মিত চলে আসে, যা পরে সংঘর্ষের সৃষ্টি করে।

বিশ্বজুড়ে পরিবেশবিদরা এখন ‘মানব-পশু সংঘর্ষ’ (Human-Wildlife Conflict) বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা করছেন। এর মাধ্যমে জানা যাচ্ছে, কোথায় মানুষ কতটা প্রভাব ফেলছে প্রাণীর আবাসে এবং প্রাণীরা কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয়, বিশেষ করে ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে এই সমস্যা প্রকট। যদি আমরা বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে সমস্যার সমাধান না করি, তাহলে ভবিষ্যতে প্রাণীদের বিলুপ্তি ঘটবে এবং মানুষ আরও বড় বিপদের মুখোমুখি হবে।

এক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। বন্যপ্রাণীর জরিপ, হুমকির মানচিত্র (risk map) এবং মৌসুমি চিত্র বিশ্লেষণ করে একটি সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা তৈরি করা যেতে পারে।

সবশেষে, পরিবেশ রক্ষা ও প্রাণীর নিরাপদ বাসস্থান নিশ্চিত করার মাধ্যমেই মানুষ ও প্রাণীর মধ্যকার বিরোধ কমানো সম্ভব। আমরা যদি এখনই উদ্যোগ না নেই, তবে ভবিষ্যতে এর চেয়েও জটিল সংকটের মুখোমুখি হতে হবে, যা শুধু প্রাণীর নয়, মানব সভ্যতার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

ড. কবিরুল বাশার : অধ্যাপক, প্রাণীবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
professorkabirul@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *