চক্রের খপ্পড়ে পিন কোড যোগ-বিয়োগে গ্রাহকের অর্ধকোটি টাকা হাওয়া

করোনাকালে অনুদান ও উপবৃত্তির টাকা দেওয়ার নামে অভিনব কায়দায় প্রতারণা করেছে কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্র। শিক্ষাবোর্ডের নামে ভুয়া নাম্বার ব্যবহারে অভিভাবকদের ফোনে কল করে কৌশলে নেওয়া হয় পিন কোড। উপবৃত্তির টাকার সঙ্গে পিন কোড, কখনো পাসওয়ার্ড যোগ-বিয়োগে কৌশলে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপসের গোপনীয়তা জেনে হাতিয়ে নেওয়া হয় টাকা। যা দ্রুত বিভিন্ন নাম্বারে অল্প অল্প করে ট্রানজেকশনে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি বলছে, উপবৃত্তি দেওয়ার নামে কয়েকটি প্রতারক চক্রের অভিনব প্রতারণায় উৎকণ্ঠায় রয়েছেন শিক্ষার্থী, অভিভাবকরা। গত ৩/৪ বছর ধরে সক্রিয় একটি প্রতারক চক্রের ১২ সদস্যকে শনাক্ত করেছেন। এরমধ্যে চক্রের প্রধান আশিকুর রহমানসহ (২৫) তিনকে গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হয়েছেন তারা।

বুধবার (২৫ মে) দুপুরে রাজধানীর মালিবাগ সিআইডি কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান এলআইসি শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার মুক্তা ধর।

তিনি বলেন, প্রতারক চক্রের সদস্যরা গণহারে বিভিন্ন নাম্বারে মেসেজ পাঠায়। শিক্ষাবোর্ডের নামে ভুয়া নাম্বার দিয়ে যোগাযোগ করতে বলে। কোনো সরলমনা শিক্ষার্থী বা অভিভাবক যদি ফাঁদে পা দেন, তাকে মোটা অংকের টাকা পাঠিয়ে প্রতারিত হতে হচ্ছে। এধরনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন থানায় প্রতারণা আইনে মামলাও হয়েছে।

বিষয়টি নজরে আসার পর সিআইডি’র এলআইসি’র একটি দল চক্রটিকে শনাক্ত ও তাদের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধান শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় একাধিক প্রতারণার চক্র শনাক্ত করা হয়।

প্রতারিত ব্যক্তি ও বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ও সরেজমিন পাওয়া তথ্য সংগ্রহ বিশ্লেষণসহ ঘটনায় ১২ জনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। এরমধ্যে আশিকুর রহমান হচ্ছেন চক্রের প্রধান। তিনি ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার কাউলিবেড়ার মটরা আবু কলাম মোল্লার ছেলে।

এলআইসি’র একটি দল অভিযান চালিয়ে মঙ্গলবার (২৪ মে) দিবাগত রাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী মাতুয়াইল এলাকা থেকে আশিকুরকে গ্রেপ্তার করে। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে চক্রের মো. সাইফুল ইসলাম (৩০) ও মোক্তার হোসেন (৩৪) নামে একই এলাকার আরও দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেপ্তাররা প্রায় ৩/৪ বছর ধরে উপবৃত্তির বিভিন্ন শিক্ষার্থীর মোবাইল নাম্বারে মেসেজ দিয়ে প্রতারণা করে আসছিল। উপবৃত্তির টাকা দেওয়ার নামে প্রতারণা সম্পর্কে মুক্তা ধর বলেন, প্রথমে শিক্ষাবোর্ডের নামে টার্গেট করা মোবাইল নাম্বারে মেসেজ দিয়ে যোগাযোগের নাম্বার হিসেবে চক্রের সদস্যের নাম্বার দেওয়া হয়। করোনার আগে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উপবৃত্তির টাকা দেওয়া হলেও করোনার সময় সেটি বন্ধ থাকায় সে সুযোগ নেয় প্রতারক চক্র। চক্রের সদস্যরা শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের উপবৃত্তির টাকা দেওয়া হচ্ছে বলে প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন অংকের টাকা প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়।

প্রতারণার কৌশল

একটি চক্রের সদস্য সংখ্যা ৩/৪ জন। এদের মধ্যে প্রথম সদস্য বিকাশ, নগদ বা রকেটের দোকানে টাকা বিকাশ করার কথা বলে দোকানে অবস্থান নেয়। কৌশলে বিকাশ গ্রাহকের লেনদেনের খাতার ছবি তুলে নেয় তারা। ওই ছবি ইমো, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে দ্বিতীয় সদস্যের কাছে পাঠিয়ে দেয়।

দ্বিতীয় সদস্যের তখন কাজ হয় পিন কোড সংগ্রহ করা। সে ভিকটিমকে কল করে কথাবার্তার মাধ্যমে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে। এক পর্যায়ে উপবৃত্তির যে পরিমাণ টাকা দেওয়া হবে মর্মে ঘোষণা দেওয়া হয়, তার সঙ্গে পাঠানো পিন কোডটি যোগ বা বিয়োগ করে সংখ্যাটি জানাতে বলা হয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফাঁদে পড়ে পিন কোডটি যোগ-বিয়োগ করে জানিয়ে দেন ওই ব্যক্তি।

তৃতীয় সদস্য তখন বিকাশ, নগদ বা রকেট অ্যাপ সাপোর্ট করে এমন অ্যান্ড্রয়েড ফোনের অ্যাপটি লগ-ইন করলে ভেরিফিকেশন কোড যায়। তখন দ্বিতীয় সদস্য কর্তৃক ভেরিফিকেশন সংগ্রহ করা কোড নাম্বার ব্যবহার করে চক্রের ভুক্তভোগীর মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপসটি সক্রিয় করে। তাৎক্ষণিকভাবে চক্রের তৃতীয় সদস্য ওই টাকা তাদের দলনেতা আশিকসহ বিভিন্ন জনের নাম্বারে সেন্ড মানি ও ক্যাশ আউট করে প্রত্যেক সদস্য বণ্টন করে নেয়।

প্রতারণায় ব্যবহার হচ্ছে ভুয়া এনআইডিতে নিবন্ধিত সিম

পুলিশ সুপার মুক্তা ধর বলেন, গ্রেপ্তার চক্রের প্রধান আশিক মূলত ভুয়া এনআইডিতে রেজিস্ট্রেশন করা সিমকার্ডগুলো সংগ্রহ করে সদস্যদেরকে সরবরাহ করে থাকে। যে কারণে তাদের শনাক্ত করাটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য কঠিন। চক্রটি করোনাকালীন সময়ে অনুদান দেওয়া হচ্ছে এবং অনুদান পাওয়ার জন্য পিন কোড ও ভেরিফিকেশন কোডটি তাদের দিতে হবে মর্মে প্রভাবিত করে তাদের কাছ থেকে পাসওয়ার্ড নিয়ে মোবাইলে আর্থিক লেনদেনের প্লাটফর্ম ব্যবহার করেও প্রতারণা করে আসছিল। এভাবে গত ২/৩ বছরে চক্রটি ভুক্তভোগীদের ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নিয়েছে অর্ধ কোটি টাকা। সেই টাকায় বিলাসবহুল জীবনযাপন করে আসছিলেন তারা।

গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আদালতে বিচারাধীন। রুনা খাতুন নামে প্রতারিত এক এক ভুক্তভোগীর রাজধানীর লালবাগ থানায় দায়ের করা মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে আজ আদালতে সোপর্দ করা হবে।