
মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা যত বাড়ছে, ততই দানা বাঁধছে জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে বৈশ্বিক উদ্বেগ। বিশেষত ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের জেরে নতুন করে আলোচনায় এসেছে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ হরমুজ প্রণালী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রণালী বন্ধ হলে শুধু তেলের দাম নয়, বিশ্ব অর্থনীতি ও নিরাপত্তায় বড় ধরনের অভিঘাত আসতে পারে। আর এশিয়া তো রীতিমতো চাপে পড়বে।
কারণ, বিশ্বের মোট জ্বালানি সরবরাহের একটি বড় অংশ—প্রতিদিন গড়ে ২ কোটির কাছাকাছি ব্যারেল তেল—এই হরমুজ প্রণালী দিয়েই পরিবাহিত হয়। এ কারণেই এই জলপথটিকে বলা হয় ‘জ্বালানির দরজা’।
প্রণালী কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলো?
পারস্য উপসাগর ও ওমান উপসাগরের সংযোগস্থলে অবস্থিত হরমুজ প্রণালী। এটি উত্তরে ইরান এবং দক্ষিণে ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মাঝখানে। দৈর্ঘ্যে প্রায় ৪০ কিলোমিটার আর প্রস্থ মাত্র ৩৪ কিলোমিটার। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এই সরু পথ দিয়েই রপ্তানি হয় মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ তেল ও গ্যাস।
এ পথ দিয়েই সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, কুয়েত, কাতার ও আমিরাত—এই ছয় দেশের বিশাল পরিমাণ জ্বালানি রপ্তানি হয়। ফলে এটি শুধুই একটি নৌপথ নয়, বরং পুরো জ্বালানি বাজারের রক্তপ্রবাহ।
মার্কিন জ্বালানি তথ্য প্রশাসন (EIA) বলছে, বিশ্বের মোট অপরিশোধিত তেলের প্রায় ২০ শতাংশই এই পথ দিয়ে সরবরাহ হয়। অর্থাৎ, হরমুজ প্রণালী বন্ধ মানেই বিশ্ববাজারে জ্বালানির ‘হার্ট অ্যাটাক’।
ইরানের অবস্থান ও হুমকি
ইরান বহুবার হুমকি দিয়েছে এই প্রণালী বন্ধ করে দেওয়ার। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েলের সঙ্গে যখনই সম্পর্ক তলানিতে গিয়েছে। ২০১২ সালেও ইরান বলেছিল, নিষেধাজ্ঞা এড়াতে হলে পশ্চিমা বিশ্বকে তাদের দাবি মানতে হবে—না হলে হরমুজ বন্ধ।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, হুমকি থাকলেও এই পথে পুরোপুরি অবরোধ দেওয়া সহজ নয়। কারণ, এটি আন্তর্জাতিক জলসীমা। এখানে মার্কিন নৌবাহিনীর পঞ্চম নৌবহর নিয়মিত টহল দেয়। তবুও ইরান চাইলে মাইন পেতে বা সাময়িক হামলা চালিয়ে রুট অস্থির করতে পারে।
হরমুজ বন্ধ হলে কার ক্ষতি?
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো। কারণ, এই দেশগুলোর তেল-গ্যাস আমদানির বড় অংশ আসে হরমুজ হয়ে।
বিশেষ করে ভারতের মোট আমদানিকৃত অপরিশোধিত তেলের ৮৫ শতাংশের বেশি এই পথ হয়ে আসে। আবার বাংলাদেশও এই পথের ওপর নির্ভর করে সৌদি আরব ও কাতার থেকে গ্যাস ও ডিজেল আমদানির জন্য।
অর্থাৎ, হরমুজ প্রণালী বন্ধ মানেই বাংলাদেশে জ্বালানি সংকট, বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিঘ্ন, শিল্পে ব্যয়বৃদ্ধি এবং সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতির ঝুঁকি।
বিকল্প রুট আছে কি?
সৌদি আরব ও আমিরাত হরমুজ ছাড়াও তেল পরিবহনের বিকল্প পাইপলাইন তৈরি করেছে।
- সৌদির ইস্ট-ওয়েস্ট পাইপলাইন প্রতিদিন ৫০ লাখ ব্যারেল তেল সরবরাহ করতে পারে।
- আমিরাতের আবু ধাবি ক্রুড অয়েল পাইপলাইন (ADCOP) ফুজাইরাহ বন্দরে তেল পাঠায় সরাসরি।
তবে এগুলোর মোট পরিবহণ সক্ষমতা এখনও হরমুজ প্রণালীকে পুরোপুরি বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করার মতো নয়। এছাড়া জাহাজগুলোকে আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে ঘুরে আনতে হলে খরচ ও সময় দুই-ই বাড়বে। যা তেলের বাজারকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে।
বাংলাদেশের জন্য কী বার্তা?
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে এখনই বিকল্প জ্বালানি রুট, উৎস ও সংরক্ষণ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। নয়তো কোনো প্রণালী সংকট বা যুদ্ধ পরিস্থিতিতে তেলের দাম বাড়লেই অভ্যন্তরীণ বাজারে হাহাকার দেখা দিতে পারে।
সরকারের নীতিনির্ধারকদের জ্বালানি সাশ্রয়, এলএনজি রিজার্ভ এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে আরও জোর দিতে হবে। আন্তর্জাতিক কূটনীতিতেও সক্রিয় থাকতে হবে যেন এ ধরনের সংকটে দ্রুত সমাধানের পথ বের হয়।
হরমুজ প্রণালী বিশ্ব অর্থনীতির এক সংকীর্ণ কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিরা। এই শিরায় রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত মানেই বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানির হাহাকার। এই জলপথ বন্ধ হলে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, কাঁপবে পুরো এশিয়া—বাংলাদেশও রেহাই পাবে না।