সারাদেশ

মাছ কেটে জীবিকা—রংপুরের নারীদের জীবনের গল্প

আপডেট: নভে ১২, ২০২৫ : ০৬:১৫ এএম
মাছ কেটে জীবিকা—রংপুরের নারীদের জীবনের গল্প

রংপুর নগরীর সিগারেট কোম্পানি এলাকার বাসিন্দা মরিয়ম বেগম। জীবনের সংগ্রামে টিকে থাকার পথ হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন মাছ কাটার কাজ। এই পেশাতেই কেটে গেছে তার ৩৩টি বছর। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে গৃহস্থালির কাজ শেষ করে ছুটে যান রংপুর সিটি বাজারে। সারাদিন মাছ কেটে যা আয় হয়, তাই দিয়েই চলে সংসারের খরচ।

একই বাজারে আমাশু কুকরুল এলাকার শেফালী বেগমও কাজ করছেন প্রায় ১০ বছর ধরে। মরিয়ম ও শেফালীর মতোই এই বাজারে অর্ধশতাধিক নারী প্রতিদিন ধারালো বটি হাতে মাছ কাটেন জীবিকার তাগিদে। তাদের মধ্যে অনেকেই বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা বা অভাবগ্রস্ত পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য। উনুনের ছাই আর কাঁটার গন্ধমাখা এই কাজই তাদের জীবনের অবলম্বন।

বাজারে ক্রেতারাও এখন ছোট-বড় মাছ কেটে নিতে পছন্দ করেন। ঝামেলামুক্ত রান্নার সুবিধায় দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে মাছ কাটার এই পেশা।  কথা হয় অভিজ্ঞ মাছকাটা শ্রমিক মরিয়ম বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, অভাবের সংসারে হাল ধরতেই ৩২-৩৩ বছর আগে এই কাজ শুরু করি। তখন ২-৪ জন এ পেশায় ছিল, এখন প্রায় ৫০ জন নারী মাছ কাটার কাজে যুক্ত।

প্রতিদিন ছোট মাছ কাটা বাবদ প্রতি কেজি ৩০ টাকা ও বড় মাছের জন্য ২০ টাকা নেন তারা। তবে সবাই দাম দেন না বলে দুঃখের সুরে জানান মরিয়ম। বর্তমানে প্রতিদিন ৫০০-৬০০ টাকা আয় হলেও জায়গা ভাড়া, ইজারা, পানি ও ময়লা পরিষ্কার বাবদ বাজার কর্তৃপক্ষকে দিতে হয় প্রায় ১০০ টাকা। খরচ বাদে যা থাকে, তাই দিয়েই চলে সংসার। আগে আয় কিছুটা বেশি হলেও এখন তা কমে এসেছে বলে জানান তিনি।

মরিয়মের মতোই শেফালী বেগমও জানান, এই হবে হয়তো ১০-১২ বছর। কাজ না করলে পেটে ভাত যায় না। প্রতিদিন বাজারে আসতেই হয়। ষাটোর্ধ্ব রাবেয়া বেগম বলেন, মাছ কেটে সংসার চালাতে হয়। মেয়ের বিয়ে, নাতি-নাতনির পড়াশোনা, নিজের ওষুধ—সব কিছুর খরচ এই আয়ের ওপর নির্ভর।

মর্জিনা বেগমের আক্ষেপ, স্থায়ী জায়গার ব্যবস্থা আর প্রতিদিনের ভাড়া ১০০ টাকা যদি মওকুফ করা যেত, তাহলে একটু স্বস্তিতে কাজ করতে পারতাম। ফরিদা বেগম জানান, “অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল, দুই বছর পর স্বামী চলে যায়। তখন থেকেই মাছ কাটার কাজ করছি। মাছ কেটেই দিন চলে। বাজারে মাছ কাটাতে আসা ক্রেতা আলম মিয়া বলেন, বাড়িতে ছোট মাছ কাটা ঝামেলা। তাই এখানে এসে কেটে নেই। এতে ১৫-২০ টাকা বেশি গেলেও সুবিধা হয়। এই নারীদের কারণে ছোট মাছের স্বাদ উপভোগ করতে পারছি।
আরেক ক্রেতা আলমগীর হোসেনের মতে, তাদের এই পেশা সমাজের জন্য উপকারী। তারা আয় করছেন, আমরা পাচ্ছি সুবিধা—দু’পক্ষই উপকৃত।

রংপুর সিটি বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সদস্য মনির বলেন, এই বাজারে প্রায় অর্ধশত নারী মাছ কেটে সংসার চালাচ্ছেন। কেউ কেউ ২৫-৩০ বছর ধরে এই পেশায় আছেন। অনেকেই এতে করে সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন। আমরাও তাদের সহায়তার চেষ্টা করি। রংপুরের এই সিটি বাজারে প্রতিদিনের ব্যস্ততার ভেতর দিয়ে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন এসব নারী। ধারালো বটি হাতে প্রতিটি মাছের সঙ্গে যেন তারা কাটেন জীবনের কঠিন বাস্তবতাকেও। তবুও হাসিমুখে দিন পার করেন, কারণ—এই হাতের বটিই তাদের জীবনের ভরসা।


আরএস

Tags:
রংপুর

০ মন্তব্য


No comments yet. Be the first to comment!