নাগরিকের কথা ডেস্ক

ইতিহাসের অমূল্য স্মারক বগুড়ার খেরুয়া মসজিদ

আপডেট: নভে ১৬, ২০২৫ : ০৬:১৩ এএম
ইতিহাসের অমূল্য স্মারক বগুড়ার খেরুয়া মসজিদ

বগুড়ার শেরপুরে প্রায় সাড়ে চারশ বছর আগে নির্মিত খেরুয়া মসজিদ আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর স্থাপত্যশৈলী, আধ্যাত্মিক পরিবেশ এবং অনন্য নির্মাণকৌশল দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। দেশজুড়ে মুসলিম স্থাপত্যের যে অল্প কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন রয়েছে, তার মধ্যে এই মসজিদটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

বগুড়া শহর থেকে প্রায় ২৩ কিলোমিটার দূরে শেরপুর উপজেলার খন্দকারটোলা গ্রামের শান্ত-সবুজ পরিবেশে অবস্থিত এই মসজিদ। চারপাশ ঘেরা সীমানা প্রাচীর পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলে চোখে পড়ে প্রতিষ্ঠাতার কবর, যা মসজিদের ইতিহাসকে আরও জীবন্ত করে তোলে।
ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, সুলতানি ও মুগল স্থাপত্যের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই মসজিদটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন আব্দুস সামাদ ফকির। মীর্জা নবাব মুরাদ খানের পৃষ্ঠপোষকতায় ৯৮৯ হিজরি (১৫৮২ খ্রিস্টাব্দ) এ নির্মাণকাজ শুরু হয়। উত্তর-দক্ষিণমুখী এই স্থাপনার বাইরের দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৭ ফুট এবং প্রস্থ ২৪ ফুট। ভেতরের অংশ তুলনামূলকভাবে ছোট, দৈর্ঘ্য ৪৫ ফুট ও প্রস্থ ১২ ফুট। দেয়ালের পুরুত্ব প্রায় ৬ ফুট, যা তৎকালীন নির্মাণশক্তির পরিচায়ক।
তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদের চার কোণায় চারটি মিনার আছে। পূর্ব দেয়ালে তিনটি এবং উত্তর-দক্ষিণ দেয়ালে আরও দুটি দরজা, সব মিলিয়ে পাঁচটি প্রবেশপথ। ভেতরে তিনটি মেহরাব রয়েছে। ধনুকাকৃতির কার্নিশের নিচে সারিবদ্ধ খিলান ও অলংকরণ মুগল স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে। দেয়ালের কিছু স্থানে পোড়া মাটির অলংকরণ ফলকও দেখা যায়, যদিও সংখ্যা অল্প।

মসজিদ নির্মাণে ইট, চুন, শুড়কি ছাড়াও বিশাল আকৃতির কৃষ্ণপাথর ব্যবহার করা হয়েছে। সামনের দেয়ালে একসময় দুটি শিলালিপি ছিল, যার একটি মূল্যবান সম্পদ সংরক্ষিত ছিল বলে ধারণা করা হয়। অপর শিলালিপিটি বর্তমানে করাচি জাদুঘরে সংরক্ষিত। আকবরের আমলে নির্মিত হওয়ায় দেয়ালের ইটের বিন্যাস, খাড়া প্যানেল এবং ফুল-লতা-পাতার নকশায় যুগের স্বাক্ষর স্পষ্ট। নব্বইয়ের দশকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উদ্যোগে মসজিদটি সংস্কার করা হয়, ফলে এটি পুরোনো রূপ ফিরে পায়। তবে কাঁচা পথের কারণে দর্শনার্থীদের কিছুটা অসুবিধা রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও মসজিদের দায়িত্বে থাকা সামাদ মিয়া জানান, দেশের বিভিন্ন স্থানসহ বিদেশ থেকেও পর্যটকরা এই মসজিদ পরিদর্শনে আসেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে নতুন প্রজন্ম মুসলিম স্থাপত্য সম্পর্কে আরও গভীর আগ্রহ অর্জন করতে পারবে।

মসজিদের মুয়াজ্জিম মো. জুবায়ের বলেন, “এই মসজিদই এ অঞ্চলের মুসলিম আমলের সবচেয়ে প্রাচীন স্থাপনা। আব্দুস সামাদ ফকির স্থানীয় অঞ্চলের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা দেখে মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। স্থানীয় শাসক মীর্জা মুরাদ খানের সহায়তায় এটি নির্মিত হয়। আমি দীর্ঘদিন ধরে মুয়াজ্জিমের দায়িত্ব পালন করছি। প্রতি ওয়াক্তে বিভিন্ন বয়সের মুসুল্লিরা এখানে নামাজ পড়তে আসেন। সরকারের পক্ষ থেকে যদি উদ্যোগ নেওয়া হয়, মুসল্লির সংখ্যা আরও বাড়বে।”
অমূল্য স্থাপত্য ও শতাব্দী পেরোনো ইতিহাসের এই খেরুয়া মসজিদ কেবল একটি উপাসনালয় নয়, এটি দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অনন্য সম্পদ। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে পর্যটন ক্ষেত্রেও নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে।

 

আরএস

০ মন্তব্য


No comments yet. Be the first to comment!