রাজধানীর বাড্ডা থেকে পুরান ঢাকার সদরঘাটে আসার উদ্দেশে ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের একটি বাসে উঠেছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০তম আবর্তনের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী অনিমা (ছদ্মনাম)। বাসে আসন ফাঁকা না থাকায় গুলিস্তান পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাকে। এই সময়ের মধ্যে যৌন হয়রানির তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন তিনি। তবে এবারই প্রথম নয়, এর আগে বই কিনতে নীলক্ষেত যাওয়ার সময়ও যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়েছে তাকে।
বাড্ডা থেকে সদরঘাটে আসার পথে সেদিনের যৌন হয়রানির ঘটনা সম্পর্কে বাংলা ট্রিবিউনকে অনিমা বলেন, “বাসের সবকটি সিটে মানুষ বসা ছিল। সামনের যে কয়টা সিট নারীদের জন্য বরাদ্দ থাকে সেখানেও পুরুষ বসা ছিল। উপায় না দেখে বাসের মাঝামাঝি দাঁড়ালাম। বাস রানিং অবস্থায় মধ্যবয়সী (৪০-৪৫ বছর) একজন পুরুষ একেবারে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। ভিড় থাকায় প্রথমে ভেবেছিলাম, অন্যমনস্ক অবস্থায় আমার শরীরে তার হাত লেগেছে। পরে আমি একটু সামনে সরে দাঁড়ালে লোকটা আবারও আমার পেছনে এসে দাঁড়ায়।”
অনিমা আরও বলেন, “একটা পর্যায়ে ভিড়ের সুযোগে জানোয়ারটা (অভিযুক্ত পুরুষ) আমার শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দেয়। আমি চিৎকার দিয়ে উঠি। যখন আমি ঘটনাটা উপস্থিত সবাইকে খুলে বললাম, তখন অনেকে বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে নিয়ে উল্টো আমাকে কটুকথা শোনালো। বললো, ‘পাবলিক বাসে এমন টুকটাক হয়, ইচ্ছে করে করেনি হয়তো। তোমার বাবার বয়সী, বাদ দাও।’ আবার কেউ বললো, একটু ধাক্কাই যদি সহ্য করতে না পারো তাহলে পাবলিক বাসে না উঠে প্রাইভেট গাড়িতে চললেই হয়।”
দ্বিতীয় ঘটনা সম্পর্কে অনিমা বলেন, “গত সেপ্টেম্বরে নীলক্ষেত থেকে বই কেনার জন্য আমি পুরান ঢাকার রায় সাহেব বাজার থেকে সাভার পরিবহনের বাসে উঠি। বাসে আমার পাশের সিটে এক মধ্যবয়স্ক (৪৫-৫০ বছর) পুরুষ বসেছিল। আমি লক্ষ করলাম, উনি তার বাম হাতের কনুই দিয়ে আমার শরীর বারবার স্পর্শ করেছিলেন। আমি উনাকে বলি, ‘আংকেল, একটু সরে বসেন।’ তখন উনি উত্তর দিলেন, ‘আরে মা তোমার বয়সী আমার মেয়ে আছে।’ অথচ ওনার স্পর্শ বাজে ছিল, যা আমি বুঝতে পেরেছি। মেয়েদের আসলে সিক্স সেন্স বলে দিতে পারে, কে ইচ্ছাকৃত স্পর্শ করেছে আর কে অনিচ্ছাকৃতভাবে।”
গণপরিবহনে এমন হয়রানির শিকার হওয়ায় আক্ষেপ করে অনিমা বলেন, “এমন ঘটনা শুধু আমার সঙ্গে নয়, আমার বান্ধবীদের সঙ্গেও হয়েছে; প্রতিনিয়ত হচ্ছে। এর থেকে প্রতিকারের আসলে কোনও উপায় নেই। মুখ বুজে সহ্য করা লাগছে। কিন্তু এমন আর কতদিন সহ্য করতে হবে? সরকার যদি গণপরিবহনে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারে সেক্ষেত্রে নারীদের জন্য একটা আলাদা পরিবহনের ব্যবস্থা করুক। একজন নারী হিসেবে আমার চাই আমার চলাচলের জন্য রাজধানীর প্রত্যেক রুটে নারী বাস সার্ভিস চালু করা হোক। নারীদের নিরাপদ চলাচলের বাহন হোক।”
৮৩ শতাংশ নারী বাসে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার
অনিমার মতো এমন অসংখ্য নারীকে গণপরিবহনে চলাচলের সময় প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। হাতেগোনা দু-একজন প্রতিবাদ করলেও বাকিরা ভয় বা লজ্জায় কিংবা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ার আশঙ্কায় প্রতিবাদ এড়িয়ে চলেন।
বাংলাদেশ রোড সেফটি নেটওয়ার্কের তথ্যমতে, দেশের নগর গণপরিবহনে যাতায়াতকারী নারীদের ৮৩ শতাংশ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। যাদের বেশিরভাগই নীরবে-নিভৃতে দিনের পর দিন এসব নির্যাতন সহ্য করে চলেছেন।
গণপরিবহনে নারীদের হয়রানির বিষয়ে বাংলাদেশ রোড সেফটি নেটওয়ার্কের সমন্বয়ক পাহাড়ি ভট্টাচার্য বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “গণপরিবহনে যাতায়াতকারী নারীদের ৮৩ শতাংশ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। গণপরিবহন কোনোভাবেই নারীবান্ধব নয়। বাসগুলো কাঠামোগতভাবেও ত্রুটিপূর্ণ। অনেক সময় বাসের হেল্পাররা নারী যাত্রীদের বাসে তুলতে চান না। এছাড়াও প্রতিনিয়ত বাসের মাঝে কোনও না কোনোভাবে পুরুষ দ্বারা নারীরা হয়রানির শিকার হন। আমরা নারী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বান্ধব গণপরিবহনের দাবি করছি।”
বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীর গণপরিবহনে প্রায় ৬৪ শতাংশ নারী নানা ধরনের হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। এর মধ্যে ৪৬ দশমিক ৫ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার, ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ বুলিং, ১৫ দশমিক ২ শতাংশ সামাজিক বৈষম্য, ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ লিঙ্গবৈষম্য এবং ৮ দশমিক ২ শতাংশ বডি শেমিংয়ের শিকার হন।
নিরাপত্তার স্বার্থে প্রত্যেক বাসে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের তাগিদ
গণপরিবহনে হরহামেশা নারীদের হয়রানি করা হলেও প্রমাণের অভাবে অনেক অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনা যায় না। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে উল্টো ভুক্তভোগী নারীদের দুয়োধ্বনি শুনতে হয়। এক্ষেত্রে অপরাধীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়ার জন্য গণপরিবহনে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন অনেকে।
বেসরকারি সংস্থা দিপ্ত ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক জাকিয়া কে হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “গণপরিবহনে নারীদের হয়রানি নিত্য নতুন ঘটনা না। যতই উদ্যোগ নেওয়া হয় না কেন, তা তেমন কোনও কাজে আসে না। তবে এক্ষেত্রে ইউনিক কিছু চিন্তা ভাবনা করতে হবে। এর আগে শহরের ১০০ বাসে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছিল।” রাজধানীর প্রত্যেকটা বাসে যদি ক্যামেরা স্থাপন করা যায় তাহলে কিছুটা হলেও হয়রানি কমবে বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে দীর্ঘদিন ধরে গণপরিবহনে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের দাবি জানিয়ে আসছে আঁচল ফাউন্ডেশন। সংস্থাটির সাধারণ সম্পাদক সামিরা আক্তার বলেন, “নারীদের নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা অনেক আগেই বাসের ভেতর ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা স্থাপনের দাবি জানিয়েছি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সরকার তা আমলে নেয়নি। যার ফলে বাসে নারীদের হয়রানি করা মানুষগুলো অনায়াসে পার পেয়ে যাচ্ছে।”
রাজধানীর প্রত্যেক রুটে নারীবান্ধব বাস সার্ভিসের দাবি
রাজধানীর প্রত্যেক রুটে নারীবান্ধব বাস সার্ভিসের দাবি জানিয়েছেন গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার নারীরা। তাদের দাবি, নারীদের যাতায়াতের জন্য আলাদা পরিবহন ব্যবস্থা থাকলে যৌন হয়রানির মতো এমন ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে না।
এ বিষয়ে রাজধানীর কবি নজরুল কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী তাহমিনা আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “আমার বাসা শান্তিনগর। সপ্তাহে ন্যূনতম তিনি থেকে চার দিন কলেজে যেতে হয়। আমার মতো আরও শত শত ছাত্রী আছে নিয়মিত কলেজে যাতায়াত করে। আমি বা আমার মতো নারী শিক্ষার্থীরা পাবলিক বাসে চলাচল করে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছি। নারীদের জন্য যদি আলাদা বাস সার্ভিস চালু হয় তাহলে আমার মতো অসংখ্য নারীকে পাবলিক বাসে যে হয়রানির শিকার হতে হয় তা থেকে রক্ষা পাবো।
সূচনা আক্তার (৩২) নামের একজন নার্স বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “আমার কর্মস্থল রাজধানীর কলাবাগানে। আমি একটা বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করি। চাকরির সুবাদে আমাকে সপ্তাহে ছয়দিন বাসে চলাচল করতে হয়। বাসে চলাচল করার সময় অসংখ্যবার আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছি। চাকরি যেহেতু করি সেক্ষেত্রে বাসে যাতায়াত করা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। সেক্ষেত্রে যদি নারীদের জন্য কোনও স্পেশাল বাস সার্ভিস চালু হয় তাহলে অন্ততপক্ষে হয়রানি থেকে রেহাই পাব।”
কেবল নামেই আছে বিআরটিসির “মহিলা বাস সার্ভিস”
নারীদের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করার লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) উদ্যোগে প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলক মহিলা বাস সার্ভিস চালু করা হয়। ২০০১ সালে তা ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় সম্প্রসারণ করা হয়। ২০০৯ সালে আবার এই সেবাকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেয় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।
সর্বশেষ, ২০১৫ সালেও এ সেবায় ১২টি বাস ছিল। তবে বর্তমানে ৯টি রুটে মাত্র ৯টি বাস চলছে বলে জানিয়েছেন বিআরটিসির কর্মকর্তারা। কিন্তু এসব বাস কোন রুটে, কখন চলে বা আদৌ চলাচল করে কিনা তার সঠিক তথ্য জানেন না রাজপথে চলাচলকারী বেশিরভাগ নারী।
বিআরটিসির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন) শুকদেব ঢালীর সরবরাহ করা তথ্য অনুযায়ী, মোট ৯টি রুটে ৯টি বাস চলে ঢাকা শহরে। বনশ্রী থেকে মতিঝিল, মিরপুর থেকে কল্যাণপুর হয়ে মতিঝিল, মিরপুর ১২ থেকে ১০ নম্বর হয়ে মতিঝিল, মোহাম্মদপুর থেকে মতিঝিল, নারায়ণগঞ্জ থেকে মতিঝিল, ডেমরা থেকে মতিঝিল, রূপনগর থেকে আগারগাঁও হয়ে মতিঝিল, তালতলা থেকে কলাবাগান হয়ে মতিঝিল এবং কল্যাণপুর থেকে মতিঝিল রুটে চলে এসব বাস।
প্রত্যেক রুটে বিআরটিসি'র উদ্যোগে মহিলা বাস সার্ভিস চালু করার কোনও উদ্যোগ নেয়া হবে কিনা; এমন প্রশ্নের জবাবে শুকদেব ঢালী বলেন, “প্রত্যেক রুটে মহিলা বাস সার্ভিস চালু করার এখতিয়ার তো আমার নেই। সরকার যদি এই উদ্যোগ নেয় তাহলে নিশ্চয়ই সব রুটে মহিলা বাস সার্ভিস চালু হবে।”
গণপরিবহনে যৌন অপরাধ মোকাবিলায় জরুরি ভ্রাম্যমাণ আদালত
বাংলাদেশে গণপরিবহনে যৌন অপরাধ মোকাবিলায় বিদ্যমান আইনি শূন্যতা পূরণে যথাযথ আইন প্রণয়ন অপরিহার্য বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, হয়রানি প্রতিরোধে সুস্পষ্ট আইন না থাকার কারণে এবং গণপরিবহন খাতে শৃঙ্খলা না থাকায় এ অপরাধ কমছে না।
আঁচল ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সামিরা আক্তার বলেন, “গণপরিবহনে হয়রানি বন্ধে আমাদের দশটি নির্দিষ্ট প্রস্তাবনা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা। দেখা যায়, অনেক সময় তাড়াহুড়ো বা সময়ের অভাবে বা বাড়তি ঝামেলা মনে করে অনেকে এসব এড়িয়ে যান। সেক্ষেত্রে যদি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মধ্যে দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে এর শাস্তি নিশ্চিত করা যেত তাহলে বেশ ভালো হতো।”
তিনি আরও বলেন, “গণপরিবহনে হয়রানি বন্ধে আমাদের আরও বেশ কয়েকটি প্রস্তাবনা ছিল। সেগুলো হলো, পরিবহনে আসনের বেশি যাত্রী না তোলা, বাসের চালক, তত্ত্বাবধায়ক ও সহকারীর পরিচয় উল্লেখ করে নেমপ্লেট বাধ্যতামূলক করা ইত্যাদি। এই বিষয়গুলো গণপরিবহনের ক্ষেত্রে সরকারিভাবে বাধ্যতামূলক করা হলে এবং এর ব্যত্যয় ঘটলে আইনি ব্যবস্থা নিলে কিছুটা হলেও নিরাপত্তা নিশ্চিত হতো।”
No comments yet. Be the first to comment!